শুক্রবার, মার্চ ১২, ২০২১




বাংলাদেশ ব্যাংকের তোড়জোড়

নারায়ণগঞ্জ প্রতিদিন:

সমবায় অধিদপ্তর থেকে অনুমোদন নিয়ে স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ (এসটিসি) নামের একটি প্রতিষ্ঠান সারা দেশে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ৩০০টির বেশি শাখা খুলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে এসটিসি। যদিও নারায়ণগঞ্জের বাইরে এটির কার্যক্রম পরিচালনার কোনো অনুমতি নেই। একাধিক জেলায় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে এসটিসি অফিসে তালা লাগিয়ে দিলেও লাগাম টানা যাচ্ছে না এ অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমে।

এবার প্রতিষ্ঠানটি বন্ধে সরকারের একাধিক সংস্থাকে অবহিত করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এ কাজে সায় দিয়েছেন গভর্নর ফজলে কবির। সম্প্রতি এসটিসির ৯টি শাখা পরিদর্শন শেষে একটি বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদন তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে প্রতিবেদনটি ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে (বিআরপিডি) পাঠানো হয়েছে। এতে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমের প্রমাণ পেয়েছে পরিদর্শন দল।এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সরকার, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি পাঠাতে সুপারিশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে গভর্নর বলেন, পরিদর্শন প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করার কোনো যৌক্তিকতা নেই, নিয়মও নেই। পরিদর্শনকারীরা যা খুঁজে পেয়েছেন এবং তাদের প্রস্তাবনা দ্রুত কার্যকরে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। গভর্নর সচরাচর কাউকে নির্দেশ দেন না, তার পরামর্শই নির্দেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ব্যাংকের মতো নাম ব্যবহার করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, ওয়েবসাইট খুলে এবং এসটিসি ব্যাংক লিমিটেডের নামে এফডিআর রসিদ, জমা বই, চেকবই ইত্যাদি ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন স্থানে তথাকথিত এসটিসি ব্যাংক লিমিটেড নামে পরিচালিত কার্যক্রমের কোন বৈধতা নেই। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এটির চলমান অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী। ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তি রক্ষায় অনুমোদনহীন এসটিসি ব্যাংকের সব কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করা এবং এরসঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের টাকা ফেরত পেতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সম্প্রতি শ্রীমঙ্গলে একটি শাখা খুলে জনগণের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অবৈধ প্রতিষ্ঠানটি। শাখার কার্যক্রম উদ্বোধনের জন্য পরপর দুই থেকে তিনবার ওই এলাকায় সফর করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমান (০১৭৭৭-৬৮৫৬৭৭)। প্রথমদিকে তার ব্যক্তিগত মোবাইলে যোগাযোগ করা সম্ভব হলেও পরে সেই নম্বর বন্ধ করে দেন তিনি। অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম বিষয়টি বুঝতে পেরে সেই শাখাটিও সিলগালা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পরিদর্শন কর্মকর্তাদের খবর কোনোভাবে টের পেলে শাখা বন্ধ করে পালিয়ে যাওয়ার উদাহরণও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলেন। জানতে চাইলে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এসটিসি ব্যাংকের শ্রীমঙ্গল শাখায় ৩ লাখ টাকার এফডিআর খুলেছিলাম। এখন আর টাকা ফেরত দিচ্ছে না। ইতোমধ্যে শাখাটিও বন্ধ করে দিয়েছে। আমি একা নই, আরও অনেকে আছেন। জমানো টাকা হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি। পারলে কিছু করেন। শ্রীমঙ্গলের নতুন বাজার এলাকার ব্যবসায়ী মো. সোহাল মিয়া প্রতিষ্ঠানটিতে এক লাখ টাকার এফডিআর রেখে ফেরত পাননি। এরকম ভুক্তভোগী সারা দেশে প্রায় কয়েক লাখ।পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অনেকের কাছ থেকে ১৫ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ঠিকমতো দেয়া হচ্ছে না। কোনো প্রকারের লিখিত পরীক্ষা বা মৌলিক সাক্ষাৎকার না নিয়ে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তবে তাদের কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি।সূত্র আরও জানায়, অনুমোদন ব্যতীত প্রতিষ্ঠানটি গ্রামের সহজ-সরল হতদরিদ্র জনসাধারণের কাছ থেকে ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলাসহ সারা দেশে অবৈধভাবে শাখা অফিস খুলে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে আসছে। সমিতির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এসটিসির ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন নিয়েও জটিলতা রয়েছে। সমিতিটি ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই নিবন্ধিত হলেও প্রকৃতপক্ষে সে সময়ের সদস্যদের কোনো অস্তিত্ব নেই। যারা ব্যবস্থাপনা কমিটি বলে দাবি করেন তারাও দুটি গ্রুপে বিভক্ত।দুটি ব্যবস্থাপনা কমিটির একটি আতিকুর রহমান গংয়ের পক্ষ। যার প্রধান কার্যালয় ৯৩, লিলি প্লাজা (৩য় তলায়), মৌচাক, ঢাকা। অপরপক্ষ আবুল হাসান গংয়ের। এদের প্রধান কার্যালয় এইচএম সিদ্দিক ম্যানশন, ফকিরাপুল, ঢাকা। সমিতিটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এ সব অবৈধ শাখা বন্ধের নির্দেশ দেয় সমবায় অধিদপ্তর। অনেক জেলায় স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় কিছু অবৈধ শাখা বন্ধ করা হয়েছে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই চলছে এসটিসি। এমনকি লোভনীয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে প্রচারণাও চালাচ্ছে তারা। চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। ২০১৯ সালের মে মাসে রাজশাহী মহানগরীর বর্ণালী মোড়ে মরিয়ম আলী টাওয়ারের চতুর্থ তলায় ব্যাংকটির আঞ্চলিক শাখা অফিস খুলে ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক পরিচালনার কথা বলে সঞ্চয়, ডিপিএস ও চলতি হিসাবসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে এসটিসি। তবে নাম ব্যাংক আর অনুমোদন সমবায় অধিদফতর হওয়ার খবরে শাখাটি চালু হওয়ার পর থেকেই স্থানীয়দের মাঝে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়।এর বাইরে নগরীর সাগরপাড়ায় এসটিসি ব্যাংক লিমিটেডের রাজশাহী শাখা ও বিভাগীয় কার্যালয়, পবা থানার পাশে নওহাটা শাখা অফিস, বানেশ্বর ফাতেমা হক প্লাজায় (৩য় তলায়) বানেশ্বর শাখা অফিস, মোহনপুরের কেশরহাটে একটি শাখা অফিস, তানোর পৌরশহরের চেয়ারম্যান প্লাজার দ্বিতীয় তলায় তানোর শাখা অফিস, বাগমারার ভবানীগঞ্জ বাজারের গোডাউন মোড়ে ভবানীগঞ্জ শাখা অফিসসহ রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অবাধে ব্যাংকের মতোই শাখা-প্রশাখা খুলে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এসটিসি।সার্বিক বিষয়ে জানতে এসটিসি চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমানের সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। একই অভিযোগ ভুক্তভোগীরাও করেন।

Spread the love
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eight − seven =

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর